ওয়ার্ল্ড নিউজ ২৪ বিডি ডেক্সঃ যুক্তরাষ্ট্রের ওহায়ো শহরের ইস্ট প্যালেস্টাইনে বিষাক্ত রাসায়নিকবাহী ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনায় উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে নানা প্রশ্নের জবাব চাইছেন সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা।আজ থেকে ১২ দিন আগে এই লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটে।
“ঘটনাটা এখন বেশ নাটকীয় হয়ে উঠেছে। পুরো শহরে হৈচৈ পড়ে গেছে”।বলছিলেন জেমস ফিগলে যিনি ওই লাইনচ্যুতির সাইট থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরে থাকেন।ঘটনার দিন অর্থাৎ ৩রা ফেব্রুয়ারি রাতে, ৬৩ বছর বয়সী গ্রাফিক ডিজাইনার মি. ফিগলে তাঁর নিজ সোফায় বসেছিলেন। হঠাৎই ধাতব কোনও কিছু থেমে যাওয়ার বিকট শব্দ শুনতে পান। এরপর তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে বের হোন- কী ঘটেছে তা অনুসন্ধানে। এরপর দেখতে পান ‘নারকীয় দৃশ্য’। “একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটছিল, বিস্ফোরণ অনেকটা সময় অব্যাহত ছিল এবং বাতাসে গন্ধটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল” – বলেন মি.ফিগলে।আপনি যদি আপনার পিছনের উঠোনে প্লাস্টিক পোড়ান তাহলে কালো ধোঁয়া দেখতে পান না? এটা সেরকমই ছিল। এটা শুধু কালো ছিল, কালো ধোঁয়া ছিল। বলা যায় এটা ছিল রাসায়নিকের ধোঁয়া, গন্ধ, যেটাতে চোখ জ্বলে। আর এই সময় যদি বাতাস থাকে তাহলেতো পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়”।
ওই দুর্ঘটনার পর আগুন ধরে যাওয়ায় কয়েক ব্লক দূরে বসবাসরত বাসিন্দারা ভয় পেয়ে যান।ঘটনার পর শহরটিতে বিষাক্ত ধোঁয়ার স্তম্ভ দেখা যায়।এর কয়েকদিন পর মার্কিন কর্মকর্তারা জানান যে, তারা দূষণ রোধ করতে ট্রেন থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক নিয়ন্ত্রিতভাবে বের করেছে। ট্রেনের বগিগুলোর কয়েকটাতে উচ্চতাপে রাখা ছিল ভিনাইল ক্লোরাইড নামের বিষাক্ত ও বিপজ্জনক রাসায়নিক। এরপরে কয়েকদিন ধরে হাজার হাজার মৃত মাছের দেখা মেলে ছোট ছোট খালগুলোতে, এ বিষয়টি পরে কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করেন।বাসিন্দারা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোকে জানান যে তাদের নিজেদের খামারের মুরগীও হঠাৎ করে মারা গেছে, শিয়ালগুলো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে এবং পোষা প্রাণীগুলোও অসুস্থ হয়ে পড়েছে।এছাড়া মাথাব্যথা, চোখ জ্বালাপোড়া, গলা ব্যথার অভিযোগও করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
শহরটির গভর্নর মাইক ডিওয়াইন বুধবার বলেছেন যে শহরে বাতাসের গুণমান নিরাপদ আছে, তবে বিষাক্ত রাসায়নিক যে স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই স্থানের কাছাকাছি বাসিন্দাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং তাদের অবশ্যই বোতলজাত পানি পান করা উচিত। কর্মকর্তারা স্থানীয় বাসিন্দাদের আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে তারা দুর্ঘটনাস্থল থেকে দূষিত মাটি অপসারণ করছেন এবং বাতাস ও পৌরসভার পানির গুণমান এখন স্বাভাবিক।
ট্রেনটিতে ১৫০টি বগি ছিল, যার ৫০টি দুর্ঘটনার শিকার হয়। আর এর মধ্যে ১০টিতে অনেক বিষাক্ত রাসায়নিক ছিল বলে জানান মি.ডিওয়াইন।কী কারণে ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়েছে সেই বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ড। কিন্তু তারা বলছে, যান্ত্রিক সমস্যার কারণে হয়তো এমনটা ঘটেছে। যেসব পণ্য ট্রেনটি বহন করছিল তার একটি হলো ভিনাইল ক্লোরাইড, একটি রঙহীন বিপজ্জনক গ্যাস যেটা পিভিসি প্লাস্টিক ও ভিনাইলের পণ্য তৈরিতে ব্যবহার হয়।ভিনাইল ক্লোরাইড একটি কার্সিনোজেন হিসেবেও পরিচিত।
এটি দাহ্য ও ক্যান্সার সৃষ্টিকারী গ্যাস। এই রাসায়নিকের তীব্র উপস্থিতির কারণে মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, তন্দ্রাভাব হতে পারে । এছাড়া লিভারের ক্ষতি ও লিভার ক্যান্সারের কারণও হতে পারে এই গ্যাস।কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, লাইনচ্যুত বগিগুলোর পাঁচটি থেকে বিষাক্ত ধোঁয়া বের হচ্ছিল।দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশের এক মাইলের মধ্যে বসবাসরত সবাইকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন কর্মকর্তারা আশেপাশের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়ার পর ৬ই ফেব্রুয়ারি বগিগুলো থেকে নিয়ন্ত্রিতভাবে ভিনাইল ক্লোরাইড বের করে নিকটবর্তী একটি স্থানে জমা করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন তারা।ওহায়ো ডিপার্টমেন্ট অব ন্যাচারাল রিসোর্সেস জানিয়েছে, ইস্ট প্যালেস্টাইনের সাড়ে সাত মাইল এলাকাজুড়ে ওই দুর্ঘটনার প্রভাবে বারোটি প্রজাতির প্রায় সাড়ে তিন হাজার মাছ মারা গেছে।
তবে কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতে রাসায়নিকগুলো নিজেরাই বিস্ফোরিত হয়ে ক্ষতিকর শ্রাপনেল উড়ে গেলে বেশি নিরাপদ হতো।মি. ডিওয়াইন বলছেন এটা ছিল ‘দুটো বাজে অপশনের মধ্যে একটাকে বেছে নেয়ার মতো বিষয়’। ওই রাসায়নিক পোড়ানোর পর যে ধোঁয়া উঠেছিল ইস্ট প্যালেস্টাইনে, সেই ছবি আর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। অনেকে এটাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি সিনেমার সঙ্গে তুলনা করেছেন।মঙ্গলবার ইউএস এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি জানায় যে বাতাসে এখন তেমন দূষিত কণার উপস্থিতি পাচ্ছেন না তারা।এজেন্সিটি চারশোর মতো বাড়ি পরীক্ষা করেছে তারা কোনও রাসায়নিকের উপস্থিতি পায়নি।এখনও ওই এলাকা এবং বাতাসের গুণমান পরীক্ষা করে চলেছেন কর্মকর্তারা।
‘অনেক সংশয় ও অবিশ্বাস’
যদিও ইস্ট প্যালেস্টাইনের কর্মকর্তারা বলছেন ওই এলাকায় এখন আর বিপজ্জনক কিছু নেই, কিন্তু কিছু মানুষ এখনও এই কথায় আশ্বস্ত হতে পারছেন না। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী, বিশেষ করে টুইটার ও টিকটক ব্যবহারকারীরা ভিনাইল ক্লোরাইড পোড়ানোর ছবি, ক্ষতির শিকার প্রাণীদের ছবি পোস্ট করে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আরও স্পষ্ট জবাব চাইছেন।স্থানীয় বাসিন্দাদের আশঙ্কা বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রভাব তাদের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।মৃত মাছের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর কর্মকর্তারা স্বীকার করেন যে এটা সত্যি।
ওহায়ো ডিপার্টমেন্ট অব ন্যাচারাল রিসোর্সেস জানিয়েছে, ইস্ট প্যালেস্টাইনের সাড়ে সাত মাইল এলাকাজুড়ে ওই দুর্ঘটনার প্রভাবে বারোটি প্রজাতির প্রায় সাড়ে তিন হাজার মাছ মারা গেছে। যদিও কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রেন লাইনচ্যুতি বা রাসায়নিক পোড়ানোর কারণেই যে এত মাছের মৃত্যু বা পোষা প্রাণী বা এলাকার পশুপাখির মৃত্যু হয়েছে এরকম কোনও রিপোর্ট তাদের কাছে আসেনি অন্যদিকে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম ও ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, রাসায়নিক পোড়ানোর এক সপ্তাহ পর স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করছেন যে মাথা ঘোরানো, মাথা ব্যথা, চোখ জ্বালাপোড়ার মতো সমস্যা হচ্ছে সবার। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বিবিসিকে বলেছে, ইস্ট প্যালেস্টাইনের দুর্ঘটনার পর বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে আবারও তাদের সেখানে দ্রুত ফেরত পাঠানো সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের আপত্তি ছিল।
“মনে হচ্ছে সরকার ও স্থানীয় কর্মকর্তারা খুব তাড়াতাড়ি বাসিন্দাদের ফেরত যাবার অনুমতি দিয়ে দিয়েছে” – বলছিলেন পেনএনভায়রনমেন্ট রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক ডেভিড মাসুর।“সে কারণে মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস আর সংশয় তৈরি হয়েছে এসব এজেন্সির বিরুদ্ধে, যেটা একটা বড় সমস্যা”।