দীর্ঘ পাঁচ বছরের গবেষণায় ফুল থেকে টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উন্নত জাতের পাঁচ প্রকার কলার চারা উদ্ভাবন। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের (রাবি) প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন এই গবেষণার উদ্ভাবক। তার উদ্ভাবিত নতুন জাতের এই কলা অধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন, উচ্চ ফলনশীল এবং কম সময়ে ফলন বেশি হবে। দেশব্যাপী চাষিদের মধ্যে এই কলার চারার চাহিদা বেড়েছে বহুগুণ।
দেশের অধিকাংশ জেলার কলা চাষিরা রাবির গবেষকের উন্নত জাতের কলার চাষ করে ব্যাপক লাভবান হচ্ছেন। প্রচলণ পদ্ধতির চেয়ে নতুন উদ্ভাবক কলা চাষে প্রায় ৪০শতাংশ বেশী লাভ করা সম্ভব। টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উন্নতমানের রপ্তানীযোগ্য ইউনিফরম কলা উৎপাদন করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব বলেও মনে করছেন গবেষক।
২০১৭ সালে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে কলার চারা উদ্ভাবনের জন্য প্রকল্প হাতে নেই গবেষক। এই গবেষণা কাজে ব্যয়ের জন্য বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও রাবি প্রশাসন ৪ লক্ষ টাকা প্রদান করেন। কলার স্যুট টিপ বা ফুলের টিস্যু নিয়ে প্রথমে জীবাণুমুক্ত করি। পরে ল্যামিনার ফ্লোর ভিতর নিয়ে টিস্যুকে কাচের পাত্রে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উদ্ভিদের বিভিন্ন রকমের হরমোন ও প্রয়োজনীয় কৃত্রিম খাবার ব্যবহার করে ৫-৬ মাস ধরে মাইক্রোস্যুট তৈরী করা হয়।
পরবর্তীতে এই মাইক্রোস্যুটগুলোতে হরমোন ব্যবহার করে শিকড় তৈরী করা হয়। পরে ল্যাব থেকে বের করে পলি হাউজের ভিতর সিডলিং ট্রেতে কোকোপিট ভরে তার উপর বসানো হয়। এর এক মাস পরে চারাগুলোকে মাটির পলিব্যাগে স্থানান্তর করা হয়। পলি হাউজের ভিতরে মাটির ব্যাগের চারাগুলোকে ২-৩ মাস ধরে বিশেষ পদ্ধতিতে বাইরের আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়ানো হয়। এক পর্যায়ে মাঠে রোপনের উপযুক্ত হলে সেগুলো চাষিদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। মোটকথা, ইন-ভিট্রো মাইক্রোপ্রোপাগেশন পদ্ধতিতে বিভিন্ন জাতের কলার টিস্যু কালচার চারা উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করেছি।
গবেষণার ফল বিশ্লেষণে টিস্যু চারা লাগালে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে কলার ফলন বেশী হওয়ায় শতাংশ লাভ বেশী হয়। এছাড়া টিস্যু কালচার চারা লাগালে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে ২-৩ মাস আগে কলা সংগ্রহ করা যায়। এতে করে টিস্যু, চারা লাগালে কলা চাষীরা কম সময়ে অধিক লাভবান হয়। গবেষক বলেন, টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উদ্ভাবনী এই কলার চারা কীভাবে দেশের কৃষি উন্নয়নে অবদান রাখবে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন গ্রীষ্ম ও উপ-গ্রীস্মমণ্ডলীয় দেশে কলার চাষ করা হয়। উৎপাদনের দিক থেকে খাদ্য শস্যের মধ্যে বিশ্বে কলার অবস্থান চতুর্থ। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোসহ ভারত ও ফিলিপিন শীত প্রধান দেশগুলোতে কলা রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। দেশীও কলাতে বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধির সমস্যা থাকায় বিদেশে রপ্তানীর জন্য শর্তসমূহ পূরণ করতে পারে না। বাংলাদেশের কৃষকেরা সনাতন পদ্ধতিতে কলার চাষ করায় বিদেশে রপ্তানীযোগ্য কলা উৎপাদন করতে পারে না। উদ্ভাবিত টিস্যু কালচার কলার চারা আধুনিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয়। ফলে বছরের যে কোন সময় কলার চারা রোপণ করা যায়। সনাতন পদ্ধতিতে শুধু বছরে দুই বার কলার চারা রোপন করা হয়। এই কারণে বছরের সব মাসে ভালো মানের কলা পাওয়া যায় না। এই কলার চারা ল্যাবরেটরীতে তৈরী বলে টিস্যু কালচার কলার চারা শতভাগ রোগ বা জীবাণু মুক্ত হয়। যারফলে কীটনাশক কম ব্যবহার করতে হয়। এটি লাগালে সময় ও জাতভেদে ৫-৭ মাসের মধ্যেই কলার মোচা বের হয় এবং ৯-১১ মাসের মধ্যে কলা কলা সংগ্রহ করা যায়।
রাবির গবেষণার উদ্ভাবক অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মূল লক্ষ্য হলো- অল্প খরচে দেশের ১৮ কোটি মানুষকে স্বল্প মূল্যে অধিক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন নির্ভেজাল কলা খাওয়ানো। পাশাপাশি টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারা সারাদেশে ব্যাপকহারে চাষাবাদের জন্য চাষিদের উদ্বুদ্ধ করা। গত ২ বছর পুরো দেশের কৃষকদের মাঝে পাঁচ জাতের চারা মূল্যে-বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে কৃষকদের কাছ থেকে অভাবনীয় চাহিদা রয়েছে। দেশের প্রত্যেক জেলার শত শত কৃষক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর পেয়ে এই চারা নিয়ে গিয়ে তারা চাষাবাদ করছে। গবেষণার ফলাফলে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত কলার চারা দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি বর্তমান সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, ‘টিস্যু কালচারের মাধ্যমে রাবির গবেষকদের উদ্ভাবিত উন্নতজাতের কলার চারা ইতোমধ্যেই সারাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সারাদেশে বিপ্লব ঘটে যাবে। প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. তানজিমা ইয়াসমিন বলেন, ‘নতুন উদ্ভাবিত এই কলার চারা রোপনের মাধ্যমে সাধারণ কলার চেয়ে অনেক বেশি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন কলা পুরো দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।