ওয়ার্ল্ড নিউজ ২৪ বিডি ডেক্সঃ বাবা-মেয়ের সম্পর্কের একটি বিশেষ প্রভাব উভয়ের জীবনে রয়েছে। কন্যারা তাদের বাবা থেকে শেখে, সে কী ধরনের মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া উচিত। আর বাবারা তাদের কন্যাদের থেকে অমায়িক, ধৈর্যশীল এবং স্নেহময় হতে শেখে। হজরত ফাতেমা (রা.) ও হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মতো বাবা-মেয়ের সম্পর্কের মহৎ উদাহরণ আর নেই।
হজরত ফাতেমা (রা.)-এর অনুরাগঃ
হজরত ফাতেমা (রা.)-এর জন্ম হয় তখন, যখন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কার আশপাশের বিভিন্ন পর্বতে ধ্যানমগ্ন হয়ে বেশির ভাগ সময় কাটাতেন। কিন্তু এই দূরত্ব তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের নমুনাকে নির্দেশ করে না। হজরত ফাতেমা (রা.)-এর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তিনি জানতে পারেন, তার বাবা আল্লাহর বার্তাবাহক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন এবং হজরত ফাতেমা (রা.) এই সুসংবাদপ্রাপ্ত প্রথম সৌভাগ্যবানদের একজন।
যখন হজরত ফাতেমা (রা.)-এর বয়স যখন ১০ বছরের কাছাকাছি, তখন একদিন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদে হারামে নামাজ পড়া অবস্থায় কুরাইশদের একটি দল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে পৌঁছে। এর মধ্যে আবু জাহেল বলে, ‘তোমাদের মধ্যে কে মৃত পশুর নাড়িভুঁড়ি এনে মুহাম্মদের ওপর ছুড়তে পারবে?’ উকবা ইবনে আবু মুয়াইত নামে একজন নোংরা আবর্জনা নিয়ে তা সেজদারত রাসুলের ওপর ছুড়ে দেয়। হজরত ফাতেমা (রা.) এই অবক্ষয়ের সাক্ষী ছিলেন। ছোট বয়সেই বাবা মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও সম্মান দেখিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, নামাজরত পিতার শরীর থেকে আবর্জনা ফেলে দিয়ে রাসুল (সা.) এবং কাফেরদের মধ্যে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ান। কুরাইশরা তার প্রতিক্রিয়া দেখে যারপরনাই অবাক হয়।
হজরত ফাতেমা (রা.) তার বাবাকে বারবার কুরাইশদের থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতেন, কেননা রাসুল (সা.) নানাভাবে মক্কার কুরাইশদের দ্বারা অপমান এবং আঘাতের শিকার হন। রাসুল (সা.)-এর প্রতি ফাতেমার এমন আচরণ দেখে কন্যা ফাতেমার জন্য ভালোবাসা আরও প্রবল হয়। আমাদের মধ্যে কতজন প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান তাদের পিতার জন্য এমন সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে? হজরত ফাতেমা (রা.)-এর উদাহরণ থেকে শিখতে পারি, একজন আদর্শবান ও অনুগত সন্তান বলতে কী বুঝায়। আসলে পিতামাতার কাছে অসাধারণ হওয়ার জন্য কোনো বিশেষ অবস্থার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র তাদের প্রতি সম্মান ও আনুগত্য প্রদর্শন প্রয়োজন।
নবীজির পিতাসুলভ ভালোবাসা ও স্নেহ
‘এটি একটি ভুল ধারণা, বাবা হলেন পরিবারে নিছক একজন উপার্জনকারী, সংসারে সহায়তাকারী। পরিবারে বাবার ভূমিকা অর্থ প্রদান করা, সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা। আর মায়ের কাজ শুধু সন্তান লালন-পালন করা। সেই সঙ্গে মায়ের আরও দায়িত্ব মেয়েকে শেখানো, মেয়ে বা নারী হওয়ার মানে কী।’
নবী করিম (সা.)-এর জীবনের দিকে তাকালে বোঝা যায়, এটি আমাদের সমাজের মানুষের একটি ভুল ধারণা। বাবাদের তাদের কন্যার লালন-পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্তরে হজরত ফাতেমা (রা.)-এর জন্য বিশেষ স্থান ছিল। হজরত ফাতেমা (রা.) সম্পর্কে হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘যখন রাসুলুল্লাহ তাকে (ফাতেমা) আসতে দেখতেন, তিনি তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতেন, দাঁড়িয়ে তাকে চুমু খেয়ে তার হাত ধরে নিয়ে আসতেন এবং তিনি যেখানে বসেছিলেন তাকে সেখানে বসাতেন।’
নবী করিম (সা.) তার কন্যাকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন, নবীজি ফাতেমাকে শিখিয়েছেন এবং নবীজির আশপাশের সব লোককে শিক্ষা দিয়েছেন, কন্যার প্রতি উত্তম আচরণ আসলে কেমন হয়। কতজন বাবা তাদের কন্যাদের প্রতি এমন মনোযোগ ও মর্যাদা প্রদর্শন করে? কন্যাদের প্রতি বাবার দূরত্ব ও বৈরী মনোভাব প্রদর্শন আজ সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বাবা-মেয়ের সম্পর্কের প্রভাব
যেসব পিতা তাদের কন্যার সঙ্গে একটি সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করে ও বজায় রাখে, এর প্রভাব সে জীবনের পরতে পরতে অনুভব করে। বলা হয়, বাবা-মেয়ের সম্পর্ক, অনেক ফলপ্রসূ একটি সম্পর্ক। তাদের সম্পর্ক শুধু মায়া-মমতা ও পারস্পরিক সম্মানের নয়, এটা অনেকটা নির্ভরশীল সম্পর্ক। হজরত ফাতেমা (রা.) ও হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) একে-অপরের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। একদিন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত ফাতেমাকে নিমন্ত্রণ করলেন। যখন হজরত ফাতেমা আসলেন, রাসুল (সা.) তাকে চুমু খেলেন এবং তার কানে কানে কিছু বললেন। ফাতেমা কেঁদে দিলেন। অতঃপর আবার রাসুল তার কানে ফিসফিস করে কিছু বললেন এবং ফাতেমা হেসে দিলেন। হজরত আয়েশা (রা.) তা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি একই সঙ্গে হাসলে এবং কাঁদলে ফাতেমা? আল্লাহর রাসুল তোমায় কী বলেছেন?’ হজরত ফাতেমা (রা.) উত্তর দিলেন, ‘প্রথমে তিনি বলেছেন, খুব অল্পসময়ের মধ্যে তিনি তার রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন, তাই আমি কেঁদেছিলাম। তারপর তিনি বললেন, কেঁদো না, আমার পরিবারের মধ্যে তুমিই প্রথম আমার সঙ্গে যোগদান করবে। আর তাই আমি হেসেছি।’
নবী করিম (সা.) ও হজরত ফাতেমা (রা.)-এর ঘটনাগুলো পিতা-কন্যার সম্পর্কের অসাধারণ উদাহরণ। কিন্তু এটা ভাবা খুবই বোকামি যে, এখনকার সময় এটা আমাদের নাগালের বাইরে। মেয়েরা হজরত ফাতেমার উদাহরণ থেকে বাবার প্রতি প্রচণ্ড আনুগত্য ও সম্মান প্রদর্শন শিখতে পারে। আর বাবারা রাসুলের আচার-আচরণ থেকে শিখতে পারেন, কন্যাকে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে। পিতা-কন্যার সম্পর্ক মূলত স্নেহপূর্ণ, সম্মান, মর্যাদা এবং স্বাচ্ছন্দ্যের। যা থেকে আমরা নবীর জীবন থেকে শিখতে পাই। আমাদের উচিত নবীর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সে অনুযায়ী জীবন গড়া।
বেশিরভাগ মেয়ের কাছেই তার পিতা একজন শ্রেষ্ঠ আইডল। হাত ধরে হাঁটতে শেখা থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে একজন মেয়ের এগিয়ে যাওয়ার মূল পথপ্রদর্শক হলেন তার পিতা। বাবা-মেয়ের সম্পর্কের মাধুর্যতা কিন্তু সর্বকালের শ্রেষ্ঠ। এই সম্পর্কের মধ্যে যেমন থাকে মান-অভিমান, তেমনই থাকে ভালোবাসা।
ওয়ার্ল্ড নিউজ ২৪ বিডি ডেক্স